
মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী : হাওরের ধ্যানমগ্ন জলছবিতে এক কাব্যচেতনা
মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী : হাওরের ধ্যানমগ্ন জলছবিতে এক কাব্যচেতনা
বলছি শুনো পরিবারের পক্ষ থেকে হাওর কবি মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালীর প্রতি বিশেষ সন্মাননা ও শ্রদ্ধাজ্ঞাপন
বাংলাদেশের সমকালীন কবিতায় মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী একটি অনন্য স্বর—যিনি জল, হাওর, স্মৃতি, প্রেম ও প্রতিবাদের অন্তর্জালকে রূপ দিয়েছেন এক বহুমাত্রিক কাব্যভাষায়। তাঁর কবিতা নিছক অলঙ্কারিক নয়, বরং এক অস্তিত্ববাদী সুরের ধ্যান; প্রান্তিক মানুষের নিঃশব্দ জবানবন্দির ভাষা। হাওরের ধূসর কাদায় দাঁড়িয়ে তিনি যে কবিতার শরীর নির্মাণ করেন, তা একই সঙ্গে লোকজ ও আধুনিক, ধ্রুপদী ও উত্তরাধুনিক, মরমিয়া এবং রাজনৈতিক।

হাওরের জলছবি ও লোকজ প্রতিসংস্কৃতি
হেলালীর কবিতায় হাওর এক গূঢ় ভূগোল, এক অনুভবী মানচিত্র—যেখানে প্রকৃতি, প্রজ্ঞা ও প্রতিবাদ একাকার হয়ে ওঠে। তাঁর কবিতা ‘ধামাইলের ভিতর বজ্রস্বপ্ন’-এ পাই:
“জলপদ্ম-মাটি এখন হাওরের আয়নায় মুখ ঢাকে,
শালতরুর শেকড়ে লুকিয়ে পড়ে জাতির নিঃশব্দ বিগ্রহ।”
এই পঙ্ক্তিমালায় কেবল প্রকৃতির চিত্র নয়, জেগে ওঠে এক জাতিস্মৃতির অশ্রুস্নাত চিহ্ন। তাঁর কবিতায় ধামাইল, বৈষ্ণব পদাবলী, পীর আখ্যান ও প্রান্তিক গীতিগুচ্ছের এক মরমি অনুরণন খুঁজে পাই, যা বাংলা কবিতায় বিরল ও গভীর।
প্রেম, ধ্যান ও জলভাষার কাব্য
হেলালীর প্রেমলক্ষণ ধ্রুপদী নয়, এটি এক নিরালোক অন্তর্জগতের অভিজ্ঞান। ‘জলাভিসার’ কবিতায় তিনি লেখেন:
“তোমার ঠোঁট—
প্রাগভাষার জলচিহ্ন
শব্দের আগেই ভিজে নিঃশ্বাস।”
এই প্রেম নির্বাক, ধ্যানমগ্ন, তবুও প্রবল। এখানে ঠোঁট হয়ে ওঠে ভাষার আগমূর্ত প্রতীক—জীবনের গানে ফিরে আসে বৃষ্টির মতো। হেলালীর কবিতায় প্রেম জ্যোৎস্নার নরম আলো নয়, বরং এক জলচেতনার গূঢ় সংগীত।
মানবতা ও প্রতিবাদের সক্রিয় কবিতা
প্রকৃতি ও প্রেমের পাশাপাশি হেলালীর কাব্যচেতনা দৃঢ়ভাবে মানবতামুখী। যুদ্ধ, নিপীড়ন, বিভাজন ও প্রান্তিক মানুষের বেদনা তাঁর কবিতার কেন্দ্রবিন্দু। এক কবিতায় তাঁর প্রত্যয়:
“এই কবিতা কোনো নিরপেক্ষতা নয়,
এ এক সক্রিয় পক্ষগ্রহণ—
মানবতার পক্ষে।”
এখানে কবিতা হয়ে ওঠে সক্রিয় ভাষ্য, যেখান থেকে উচ্চারিত হয় কাঁটাতার, যুদ্ধবিমান ও শরণার্থীর কণ্ঠস্বর।

গ্রন্থ, চর্চা ও সাহিত্যপ্রয়াস
হেলালীর সাহিত্যকর্ম কবিতা, প্রবন্ধ ও গবেষণার আন্তঃসম্পর্কে পরিপূর্ণ। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
কুড়ানো সুখ (কবিতা)
একাত্তরের যুদ্ধবীর (প্রবন্ধ)
১৯৭১: যুদ্ধজয়ীদের কথা (গবেষণা)
প্রেরণার বাতিঘর (আবদুল মজিদ মাস্টার স্মারকগ্রন্থ)
মুক্তিযুদ্ধে জননেতা আবদুল হক (জীবনী ও প্রবন্ধ)
স্বপ্ন শতদল (যৌথ কাব্যগ্রন্থ)
তিনি সম্পাদনা করেন সাহিত্যের ছোটোকাগজ ‘বাঁশতলা’, যা সীমান্তবর্তী বাস্তবতা ও প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠকে সাহিত্যে তুলে ধরার অনন্য এক প্রয়াস।
অকবিতার ভাষ্যে এক কবিতাচক্র
হেলালী সম্প্রতি শুরু করেছেন এক নতুন কবিতাচক্র—
‘অকবিতার সভ্যতা: অস্ত্রভাষ্যের জন্মচক্র’, যার প্রতিটি অংশ একেকটি ভাষ্য—প্রতিরোধ, নিঃশব্দতা ও প্রযুক্তিযন্ত্রের ভেতর হারিয়ে যাওয়া মানবিক ভাষার পুনরুদ্ধার।
১.
আকিকা হয়নি সভ্যতার—
রক্তপাতেই হল নামকরণ
মুখোশের ভিতর মুখোশ
ভেতরে—
এক শূন্য আলিঙ্গনে জমে থাকা ভালোবাসা
সংস্কৃতি জন্মেছে শূলে চড়ে
আর
ধ্বংসের স্তন্য থেকে শিখেছে উচ্চারণের কলা
আমি?
আমি এক কবিতা—
আত্মরক্তে লিখি মানুষের নাম…
২.
আমার কণ্ঠমুদ্রা বাজেয়াপ্ত
তবু আমি
তালিকা বানাই চিৎকারের
তারপর
জিহ্বার মঞ্চে নামাই
একটা শুদ্ধ চিৎকার—
যার ব্যাকরণ রাষ্ট্রের সঙ্গে মেলে না
তুমি তখন বর্ণান্ধ পতাকায় জড়িয়ে বলো
কবিতা নয়
এটা রাষ্ট্রদ্রোহ…।
৩.
আমার জিহ্বা নেই—
তবু কেউ লিখে দেয়
দিনপঞ্জির পেছনে আমার উচ্চারণ
মুখো মুখো হাওয়ায়
আমি চিনি না কণ্ঠ
শুধু
একটা রিংটোন বাজে
যেন প্রার্থনা
আধ-ডিলিটেড কোনো ঈশ্বরের নাম
তুমি বলেছিলে
ভাষা হারালেই মানুষ চুপ হয় না
সে কাঁদে ইমোজিতে…।
৪.
আমরা বলি না কিছু—
শুধু চেয়ে থাকি
ভেঙে যাওয়া স্ক্রিনে ঝুলে থাকা মুখের দিকে
কোথাও লেখা নেই আর
‘আমি’
‘তুমি’
‘আমরা’—
শুধু একটা লোডিং চিহ্ন, চিরকাল
নির্বাকদেরও একদিন
জন্ম হয় নিজস্ব স্বরছায়ায়
সেদিন
একটি ‘শব্দ’
খুঁজে পায় তার
মৃত বানান…।
কবিতার অন্য এক ভাষ্য
মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালীর কবিতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—কবিতা কেবল শব্দের বিন্যাস নয়, এটি এক জীবনচর্চা। জল, নিঃশব্দতা ও প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে তিনি তৈরি করেছেন এক গভীর দর্শন, যা বাংলা কবিতার শরীরে নবসঞ্চার ঘটিয়েছে।
তাঁর কবিতা পাঠ মানে প্রান্তিকতার সঙ্গে সংলাপে যাওয়া; মানে, জীবনের গোপন জলছবির দিকে তাকিয়ে থাকা—যেখানে এক নিরালোক স্বরের মধ্য দিয়ে উচ্চারিত হয় মানুষের গোপন ব্যথা, প্রেম ও প্রত্যয়।
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী’ র জন্ম ও বেড়ে ওঠা সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার নিভৃত পল্লী লামাসানিয়া গ্রামে। শিক্ষা: এমএ, এলএলবি। পেশা: সাংবাদিকতা ও সাহিত্যচর্চা। সম্পাদক: সাহিত্যের ছোটোকাগজ বাঁশতলা।
মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী’ র কিছু কবিতা: