
কন্টেন্ট ক্রিয়েটর হওয়ার হিড়িক !
কন্টেন্ট ক্রিয়েটর হওয়ার হিড়িক, পেশা বদল আর নিঃস্বতার চরম বাস্তবতা
সূচিপত্র
নতুন এক দিগন্তের হাতছানি
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে ফেইসবুক ও টিকটক, বর্তমান বাংলাদেশের তরুণ-যুবাদের কাছে শুধুই বিনোদনের প্ল্যাটফর্ম নয়—এটি হয়ে উঠেছে জীবিকা অর্জনের এক নতুন উপায়। অল্প খরচে স্মার্টফোন আর ইন্টারনেট সংযোগেই আজ যে কেউ হয়ে উঠতে পারে “কন্টেন্ট ক্রিয়েটর”। ভাইরাল হওয়ার স্বপ্ন, জনপ্রিয়তার হাতছানি, আর ইনকামের সম্ভাবনা অনেককে টেনে নিচ্ছে এই প্ল্যাটফর্মে। পেশা বদলের সিদ্ধান্ত ও পারিবারিক চাপের প্রতিচ্ছবি
কিন্তু এই দৌড়ে অনেকেই ভুলে যাচ্ছেন এক কঠিন বাস্তবতা—সবাই সফল হয় না। কেউ কেউ যখন লাখো অনুসারী ও স্পন্সরশিপ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন অনেকেই থেমে যাচ্ছেন মাঝপথে।
প্রথাগত পেশা ত্যাগ: আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত?
কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক, ছোট চাকুরিজীবী—অনেকেই তাদের দীর্ঘদিনের পেশা ছেড়ে ঝুঁকছেন কন্টেন্ট ক্রিয়েশনের দিকে। এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে বিশেষ করে শহরতলী ও গ্রামীণ তরুণদের মাঝে।
📌 মিলনের গল্প:
মিলন ছিলেন একজন প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক। ইউটিউব ও টিকটকে কিছু ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর তিনি পুরোপুরি শিক্ষকতা ছেড়ে দেন। কিন্তু কয়েক মাস পরেই দেখা যায়, তার ভিউ কমে যাচ্ছে, আয় প্রায় শূন্য। তখন তিনি আর স্কুলেও ফিরতে পারেননি, কারণ তার পদে অন্য শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন।
📌 রুবেলের অভিজ্ঞতা:
রুবেল একজন দিনমজুর ছিলেন। কিছু ব্যঙ্গাত্মক ভিডিও দিয়ে ভাইরাল হয়ে গেলেন। একসময় আশেপাশের লোকজনও তাকে সমর্থন করছিল। কিন্তু এখন তার ভিডিওগুলো নিয়ে কেউ আগ্রহী না। আগের কাজেও ফিরতে পারছেন না—কারণ “কন্টেন্ট ক্রিয়েটর” হিসেবে তার নতুন পরিচয় তাকে গম্ভীর শ্রমজীবী সমাজে গ্রহণযোগ্যতা হারাতে বাধ্য করেছে।
ব্যর্থতা: শুধুই জনপ্রিয়তার অভাব নয়
সাধারণ মানুষ ভাবেন, ভাইরাল না হলে ব্যর্থ। কিন্তু বাস্তবতা আরও গভীর:
- প্ল্যাটফর্ম অ্যালগরিদমের পরিবর্তন
- পেশাদার দক্ষতার অভাব (ভিডিও এডিটিং, মার্কেটিং, স্ক্রিপ্টিং)
- অপরিকল্পিত বিনিয়োগ (ক্যামেরা, মোবাইল, ইন্টারনেট খরচ)
- পারিবারিক ও সামাজিক চাপ
ফলে একজন ব্যক্তি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন, নিজেকে সমাজে বিচ্ছিন্ন মনে করেন এবং অনেকে নিঃস্বও হয়ে পড়েন।
বিকল্প পরিকল্পনার অভাব: দায় কার?
এই পরিস্থিতির জন্য কেবল কন্টেন্ট ক্রিয়েটর বা ভুক্তভোগী নয়, বরং সমাজ, মিডিয়া ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থারও দায় আছে। “উন্নয়ন মানেই শুধু প্রযুক্তি নয়, মানুষকে সেই প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার শেখানোও উন্নয়ন।”
বাংলাদেশে কন্টেন্ট নির্মাণ এখনো অনেকাংশে অপরিকল্পিত ও স্বেচ্ছাচারী পর্যায়ে রয়েছে। কোথাও নেই প্রশিক্ষণ, গাইডলাইন বা ব্যর্থদের জন্য সহায়তা।
সমাধান কী হতে পারে?
✅ দ্বৈত পেশার ধারণা:
প্রাথমিক পর্যায়ে কেউ কন্টেন্ট নির্মাণকে “পূর্ণকালীন পেশা” হিসেবে নেওয়ার আগে তার পূর্ববর্তী পেশাটিকে ধরে রাখা জরুরি।
✅ প্রশিক্ষণ ও গাইডলাইন:
সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেন সৃজনশীল কাজের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেয়।
✅ মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা:
ব্যর্থতার পর যেন কেউ হতাশাগ্রস্ত না হন—এ জন্য দরকার কাউন্সেলিং ও সাপোর্ট সেন্টার।
✅ সতর্ক বার্তা:
সোশ্যাল মিডিয়াতে জনপ্রিয়তার পেছনে না ছুটে নিজের বাস্তবতা বুঝে চলা উচিত। একজন সফল কন্টেন্ট ক্রিয়েটরের পেছনে লুকিয়ে থাকে বছরের পর বছর পরিশ্রম ও ব্যর্থতা।

ভাইরাল নয়, ভারসাম্য দরকার
আমরা যদি প্রতিটি যুবককে শুধু ভাইরাল হওয়ার স্বপ্ন দেখাই, তাহলে তারা জীবনের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম একটি মাধ্যম—লক্ষ্য নয়। পেশা পরিবর্তন হতেই পারে, তবে তা হওয়া উচিত দায়িত্বশীলভাবে ও পর্যাপ্ত প্রস্তুতির পর।
সাফল্যের গল্প যতটা মুখর, ব্যর্থতার গল্প ততটাই নিঃশব্দ। সেই নিঃশব্দতাকে প্রকাশ্যে আনা দরকার—সমাজের স্বার্থেই।
শুভ কামনা
thank you so much