
চলমান দুর্নীতি ও আমরা
চলমান দুর্নীতি ও আমরা..
দুর্নীতি-এই একটি শব্দই যেন হাজার বছরের শ্রাপ হয়ে আমাদের সমাজের শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে গ্রামের ছোট্ট ইউনিয়ন অফিস পর্যন্ত, যেখানে হাত দিই সেখানেই দেখি দুর্নীতির বিষাক্ত ছোবল। অথচ প্রশ্ন আসে, এত এত দুর্নীতি করে আমরা আসলে কি পাচ্ছি?
দেখা যায়, একটি সরকারি হাসপাতাল তৈরি হয়। উদ্বোধন হয় নানা ঢাকঢোল পিটিয়ে, কিন্তু কিছুদিন পরেই ধসে পড়ে ছাদের পলেস্তারা, কাজ করে না যন্ত্রপাতি। কারণ একটাই—উপকরণে অনিয়ম, নির্মাণে দুর্নীতি।
একজন দরিদ্র কৃষক কৃষিঋণের জন্য ব্যাংকে যায়। কাগজপত্র ঠিক থাকলেও তাকে ‘সহজে’ টাকা তুলতে হলে অফিসারের পকেট গরম করতে হয়। একজন মেধাবী ছাত্র বিসিএস-এ উত্তীর্ণ হয় না, কারণ তার জায়গায় সুপারিশধারী কেউ বসে পড়ে।

শুধু সরকার বা রাজনীতি নয়—দুর্নীতি এখন আমাদের পারিবারিক, সামাজিক এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও ঢুকে গেছে। কাব্যিকভাবে বললে, এটি যেন এক ছায়ার মতো আমাদের চিন্তা-চেতনাকে গ্রাস করেছে। আর এতে ক্ষতি কার? আমাদেরই।
দুর্নীতি ধনীকে আরও ধনী করে, গরিবকে আরও পেছনে ঠেলে দেয়। একটি জাতির উন্নয়ন তখনই সম্ভব, যখন তার নীতিনৈতিকতা দৃঢ় থাকে। কিন্তু দুর্নীতির কারণে শুধু অর্থ নয়, আমরা হারাচ্ছি বিশ্বাস, হারাচ্ছি মূল্যবোধ, হারাচ্ছি প্রজন্মের আশা।
প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অনেক জায়গায় বই, বেতন, ভর্তি, এমনকি পরীক্ষার ফলাফলেও দুর্নীতির ছোঁয়া। শিক্ষক নিয়োগে ঘুষ, সিট পেতে দালালদের ভূমিকা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কমিটিতে দলীয় রাজনীতির আধিপত্য—এসব কিছু শিক্ষাকে পণ্য বানিয়ে ফেলেছে।
সরকারি চাকুরীর নিয়োগে ‘ঘুষ দিলে হবে’—এই ধারণা এখন একটা সাধারণ কথা হয়ে গেছে। চাকরির ইন্টারভিউ মানে যেন অর্থনৈতিক লেনদেন। এতে মেধাবীরা কোণঠাসা হয়, হতাশ হয়ে পড়ে, আর দেশ হারায় তার প্রকৃত সম্পদ।
সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসার কথা বলা হলেও বাস্তবে সাধারণ রোগীকে ওষুধ কিনতে হয় বাইরে থেকে, বিভিন্ন পরীক্ষা করাতে হয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। কারণ? ঠিকাদার, চিকিৎসক এবং মেডিকেল অফিসারদের মধ্যে গোপন লেনদেন।
দুর্নীতি মানুষকে স্বার্থপর করে তোলে। পারস্পরিক আস্থা নষ্ট হয়। একজন অন্যজনকে সন্দেহের চোখে দেখে। আমরা বিশ্বাস করতে ভুলে যাই, কেউ কোনো কাজ সৎভাবে করছে। ক্রমেই মানুষ নিষ্ঠুর, হিংস্র এবং আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। সমাজ হয় অনৈতিকতায় ভরপুর।
এই সমাজে বড় হয়ে ওঠা শিশু দেখে তার বাবা ঘুষ দিয়ে কাজ আদায় করছে। সে ভাবে, এটাই স্বাভাবিক। যে যুবক দেখে রাজনৈতিক পরিচয়ে সবাই সুযোগ পাচ্ছে, সে আর মেধার পেছনে ছুটতে চায় না। ভবিষ্যৎ তখন আর আশাব্যঞ্জক থাকে না।
আছে—এবং সেটি শুরু হয় নিজের ভিতর থেকে।
নিজে সৎ থাকা, অন্যকে সৎ থাকতে উদ্বুদ্ধ করা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা এবং সচেতনতা গড়ে তোলাই হচ্ছে পরিবর্তনের পথ। ছোটখাটো অন্যায়কে প্রশ্রয় না দিয়ে সমাজে ইতিবাচক মানদণ্ড তৈরি করা এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ।
আমরা চাই একটি সুশাসিত সমাজ, যেখানে মেধা আর পরিশ্রমের মূল্য থাকবে, যেখানে মানুষের অধিকার নিশ্চিত হবে, যেখানে সরকার জনগণের জন্য কাজ করবে। কিন্তু তা পেতে হলে প্রশ্নটা এখনই করতে হবে—
“এত এত দুর্নীতি করে আমরা কি আসলেই কিছু পাই? নাকি হারাই আমাদের ভালোবাসার দেশটাকে, প্রতিদিন একটু একটু করে?”
চলমান দুর্নীতি ও আমরা.. আর্টিকেল নিয়ে যে কোন ধরনের মন্তব্য করুন। আপনাদের একটি মন্তব্য করা মানেই আপনি আমার আর্টিকেলটি পড়েছেন। আমরা লিখি সকলের জন্য। দেশ, জাতি, সমাজ, সংসার নিয়ে। আর তা যদি আপনারা শুধুই ফেসবুকের মতো স্ক্রোল করে যান তাহলে কি হবে আমাদের এই কষ্ট করে ব্লগিং করা। এই স্ক্রোল হয়তো এক সময় হারাবে চিন্তিত সকল লেখকদের।
ভালো থাকেন, সুস্থ থাকেন। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট বই পড়ুন।
