শেষ শয্যা বৃষ্টিতে ভিজে
শেষ শয্যা বৃষ্টিতে ভিজে – ঘরে হলো না ঠাই
লাশটা বাড়িতেই আছে। অথচ সেই লাশের জন্য ঘরের ভেতরে এক চিলতে জায়গাও নেই। বাইরে, বারান্দার পাশে বা বাড়ির কোন এক কোণে, হয়তো পলিথিনে মোড়া অবস্থায় পড়ে আছে শরীরটা—নির্জীব, নিস্তব্ধ। কেউ আর ডাকে না, কেউ ছুঁয়ে দেখে না। অথচ এই ঘর-দেয়াল, ছাদ-বাড়ি—সবই একদিন তৈরি হয়েছিল তারই রক্ত পানি করে উপার্জিত অর্থে।
জীবনের পঁচিশ-ত্রিশ বছর ধরে যে মানুষটা নিজের প্রয়োজন ভুলে অন্যদের স্বপ্ন গড়ে দিয়েছে, আজ তার নিজের শরীরের জন্য জায়গা হয় না সেই স্বপ্নের ঘরেই। কেমন নিদারুণ বাস্তবতা! বাড়ির পাশে একটু শুকনো জায়গায় রাখা হয়েছে মৃতদেহটি। বৃষ্টি আসছে, জল ঝরে পড়ছে ঠান্ডা শরীরটায়। পাশের ভাই, যাকে জীবনের কত সন্ধ্যায় আগলে রেখেছিল এই মানুষটি, সে নিজে আশ্রয় নিয়েছে ঘরের উষ্ণ কোণে। শুধু লাশটাই পড়ে আছে বৃষ্টির ভেজায়—নির্বাক, অভিমানী।
এটা কি কেবল একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা?
না। এ যেন আজকের সমাজের প্রতিচ্ছবি।
মানুষ আজ এতটাই আত্মকেন্দ্রিক, এতটাই সুবিধাবাদী হয়ে উঠেছে যে মৃত্যুর পরও ন্যূনতম সম্মানটুকু দিতে কারও সময় নেই। একজন মানুষ যখন জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে নিজের চাহিদা ভুলে পরিবারের জন্য আত্মত্যাগ করে, তখন সে অন্তত মৃত্যুর পর সম্মান পাওয়ার দাবি রাখে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা।
আমরা আজ এমন একটি সময় পার করছি, যেখানে সম্পর্কের শিকড় নড়ে উঠেছে।
সন্তান বড় হয় বাবা-মায়ের ঘামে, মায়ের নিঃস্ব ঘুমহীনতায়, বাবার কাঁধে জমানো কষ্টে। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে কিংবা মৃত্যুর পর সেই বাবা-মা হয়ে ওঠে “বোঝা”। সংসারের চাপে, সময়ের অভাবে, কিংবা নিজেদের ব্যস্ততায় মানুষ ভুলে যায়, যে মানুষটা আজ নিথর হয়ে পড়ে আছে—তারই হাত ধরে একদিন প্রথম হাঁটতে শেখা হয়েছিল।
এটা কেবল কোনো বৃদ্ধের বা কোনো পরিবারের গল্প নয়, এটি একটি জাতির গল্প।
আমাদের সমাজে আজ পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে নিঃশব্দে। মুখে কেউ স্বীকার করে না, কিন্তু হৃদয়ের ভিতরে ভালোবাসার জায়গাগুলো আজ শুন্য। প্রযুক্তি, ব্যস্ততা, নিজস্ব জীবনের মোহ আমাদের এতটাই ঘিরে ফেলেছে যে মানুষ হিসেবে আমাদের দায়বদ্ধতাগুলো হারিয়ে গেছে।
মৃত্যুর পর মানুষটি যেন হয়ে ওঠে অচেনা এক অবাঞ্ছিত শরীর। অথচ বেঁচে থাকাকালীন সেই মানুষটির ছায়া পড়েছিল প্রতিটি দেয়ালে, প্রতিটি আয়নায়। এখন সে নেই, তাই তার অস্তিত্বটাও যেন মুছে ফেলতে চায় সকলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই লাশটিকে দাফন করা হবে। হয়তো শবযাত্রায় কেউ জোর করে দুই হাতে ধরবে কাঁধ, কেউ মুখ বেঁকিয়ে বলবে—“আর দেরি কইরো না”।

তবুও আমরা বেঁচে থাকা মানুষরা অহংকারে বুক ফুলিয়ে চলি।
আমাদের দাপট, আমাদের বাহাদুরি, আমাদের সম্পদ—সব যেন একটা ধোঁকার মায়াজাল। মনে হয়, এ সবই চিরস্থায়ী। অথচ মৃত্যুর পর তা কতটাই বা মূল্য রাখে? কেউ যেন মুখে বলেই দেয়—“মরা মানুষকে ঘরে রাখলে অশুভ হয়”, “জমি ভিজে যাবে”, “কাজের লোক নেই আজ”। এত অজুহাত, অথচ একটু মানবিকতা, একটু সহমর্মিতা নেই।
এটা কি আমাদের শিক্ষা? আমাদের সংস্কৃতি?
আমরা তো শিখেছিলাম মৃতদেহের প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে হয়, সেটাই নৈতিকতা, সেটাই মনুষ্যত্ব। তাহলে সেই মূল্যবোধ গেল কোথায়? যে সন্তান আজ তার মৃত পিতার নিথর দেহের পাশে বসে না, সেই সন্তান কীভাবে দাবি করবে পরের প্রজন্মের ভালোবাসা?
মানুষ মূলত একা। জন্ম একা, মৃত্যু একা—এই সত্য বহু পুরনো।
কিন্তু জীবনটুকু তো আমরা একসঙ্গে কাটাতে চেয়েছিলাম! ভালোবাসা, পরিবার, সমাজ—এই সবকিছুই তো সেই একাকিত্ব থেকে মুক্তির চেষ্টা ছিল। কিন্তু আজ যখন পরিবারই মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখন প্রশ্ন জাগে—মানুষ কি তবে আবার একাই হয়ে যাচ্ছে?
এমন সমাজ আমরা তৈরি করছি কেন?
একটি সমাজ যেখানে বৃদ্ধরা বোঝা, যেখানে মৃতদের জন্য সময় নেই, সেখানে ভালোবাসা কেবল একটি মুখোশ।
আমরা কি সেই সমাজে বাস করতে চাই, যেখানে মৃত্যুর পরও মানুষ অপমানিত হয়? যেখানে একটি শরীর ভিজে যায় বৃষ্টির জলে, আর বাড়ির লোকজন দরজা বন্ধ করে মোবাইল স্ক্রলে ব্যস্ত থাকে?
এই গদ্য কেবল ক্ষোভ নয়, এটি একটা আহ্বান।
চোখ মেলে দেখুন আমাদের চারপাশ।
একটু সময় দিন পরিবারকে, বয়স্ক বাবা-মাকে, মৃত আত্মীয়কে সম্মান জানাতে। কারণ আজ যিনি লাশ, কাল আমরাও সেই পথের যাত্রী হবো। তখন যদি আমরাও এমন অবহেলা পাই, তাহলে যে দুঃখটা বুকের ভিতর গুমরে কাঁদবে, তার জন্য তখন আর কেউ থাকবে না।
একজন মৃত মানুষের মর্যাদা যেদিন ঘরের কোণায় স্থান পায় না, সেদিন বুঝে নিতে হবে, সমাজটাও আসলে মরেই গেছে। শুধু তাকে এখনও দাফন করা হয়নি। আমাদের উচিত, জীবিত এবং মৃত উভয়ের জন্য মানবিক হওয়া, কারণ একমাত্র এই মানবিকতাই আমাদের মানুষ করে রাখে।
শেষ শয্যা বৃষ্টিতে ভিজে
03.06.2025
একান্তই নিজস্ব এলোমেলো ভাবনা, দর্শন, মুক্তচিন্তার প্রচারে- বলছি শুনো ডট কম


বেশ ভাবনাময় লেখেছেন ভাই এই পৃথিবীর নিঠুর হলো মৃত্যু মৃত্যুর চেয়ে নিঠুন আর কিছু হয় না