
উপজেলা নির্বাহী অফিসার, মাঠ প্রশাসনের অগ্রসেনানী
উপজেলা নির্বাহী অফিসার, মাঠ প্রশাসনের অগ্রসেনানী
বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ একটি স্তর হলো উপজেলা প্রশাসন, যার নেতৃত্বে থাকেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও)। তাঁরা মাঠপর্যায়ে সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেওয়ার কাজে নিয়োজিত থাকেন। একজন ইউএনও কেবল একটি প্রশাসনিক পদ নয়, বরং এটি হচ্ছে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জনকল্যাণ নিশ্চিত করার অন্যতম চালিকাশক্তি। দেশের সার্বিক উন্নয়ন, আইনশৃঙ্খলা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং সেবাখাতের কার্যকর বাস্তবায়নে ইউএনওদের ভূমিকা এককথায় অপরিসীম।
ইউএনও–এর প্রশাসনিক ভূমিকা
একজন ইউএনও একটি উপজেলার সরকারি প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা। তিনি সরকারের কেন্দ্রীয় নীতিকে স্থানীয় স্তরে বাস্তবায়নের প্রধান দায়িত্ব পালন করেন। উপজেলা পর্যায়ে সকল দপ্তরের কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন, তদারকি এবং সুশৃঙ্খল প্রশাসন পরিচালনা করা তাঁর নিত্যকার কাজ।
তিনি উপজেলা পরিষদের সচিব হিসেবে কাজ করেন এবং চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের সঙ্গে সমন্বয় করে স্থানীয় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন। তাঁর নেতৃত্বে উপজেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটি, আইনশৃঙ্খলা কমিটি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি, শিশু ও নারী উন্নয়ন কমিটিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কমিটি কাজ করে থাকে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা
ইউএনওদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে উপজেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। তিনি আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি হিসেবে এলাকার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, মাদক, চুরি-ডাকাতি, বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং প্রভৃতি সামাজিক ব্যাধি প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করেন।
একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তিনি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন। যেখানে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে খাদ্যে ভেজাল, অবৈধ দখল, পরিবেশ দূষণ, অতিরিক্ত মূল্য আদায়সহ বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এসব তৎপরতা সাধারণ মানুষের মধ্যে সরকার ও প্রশাসনের প্রতি আস্থা তৈরি করে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও সংকটকালীন নেতৃত্ব
বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, ভূমিধস ইত্যাদি দুর্যোগের সময় ইউএনওরাই মাঠপর্যায়ে সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তাঁরা আশ্রয়কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা, খাদ্য ও চিকিৎসা সরবরাহ, এবং ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রস্তুতসহ সকল কার্যক্রম তদারকি করেন।
করোনা মহামারি চলাকালীন ইউএনওদের দৃঢ় ও সাহসিক নেতৃত্ব দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। তাঁরা ঘরে ঘরে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া, স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবায়ন, লকডাউন তদারকি, জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নে নেতৃত্ব
সরকার ঘোষিত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প যেমন—সড়ক নির্মাণ, ব্রিজ-কালভার্ট, স্কুল-কলেজ সংস্কার, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন ইত্যাদি বাস্তবায়নে ইউএনও’র ভূমিকা মুখ্য। তিনি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস, শিক্ষা অফিস, কৃষি অফিসসহ বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করে উন্নয়ন প্রকল্পের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিশ্চিত করেন।
এছাড়া ইউএনও জনগণের সরাসরি অভিযোগ গ্রহণ, গণশুনানি আয়োজন এবং স্থানীয় সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন, যা জনগণের আস্থা অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে ভূমিকা
বর্তমানে সরকার “ডিজিটাল বাংলাদেশ” রূপকল্প বাস্তবায়নের পথে অনেকদূর এগিয়েছে। ইউএনওগণ উপজেলা পর্যায়ে ই-গভর্ন্যান্স, ডিজিটাল রেকর্ড ব্যবস্থাপনা, অনলাইন জন্মনিবন্ধন, ভূমি সেবা ডিজিটালাইজেশন, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার পরিচালনা ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণকে প্রযুক্তিনির্ভর সেবা প্রদান করছেন।
উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ই-সেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, চাকরি সংক্রান্ত তথ্য প্রদানসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ সেবা ইউএনওর তত্ত্বাবধানে জনগণের হাতের মুঠোয় পৌঁছে গেছে।
নারী ইউএনওদের অগ্রণী ভূমিকা
বর্তমানে অনেক উপজেলায় নারী ইউএনও কর্মরত রয়েছেন, যারা দক্ষতা, দৃঢ়তা ও সাহসিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁরা স্থানীয় রাজনীতি, সামাজিক চ্যালেঞ্জ এবং কখনো কখনো ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যেও জনসেবার ব্রত নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, নারী ইউএনওরা বাল্যবিবাহ, নারী নির্যাতন, কিশোরীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছেন, যা সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা
তবে ইউএনওদের কাজ করতে গিয়ে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। যেমন:
- রাজনৈতিক চাপ ও প্রভাব মোকাবেলা
- নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি (বিচ্ছিন্ন ঘটনায় ইউএনওদের ওপর হামলা হয়েছে)
- পর্যাপ্ত জনবল ও বাজেট সংকট
- কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয়হীনতা
তবে এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ইউএনওরা তাঁদের কর্তব্যপালনে অটল থেকেছেন।
বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোর ভিত্তি হলো মাঠপর্যায়ের কার্যকারিতা। উপজেলা নির্বাহী অফিসারগণ সেই কাঠামোর মেরুদণ্ড। তাঁরা একাধারে প্রশাসক, নীতি বাস্তবায়নকারী, বিচারক, সেবক এবং জনগণের আস্থা অর্জনকারী নেতা। দেশের উন্নয়ন, সুশাসন এবং জনকল্যাণ নিশ্চিত করতে ইউএনওদের ভূমিকা আরও জোরদার করতে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, এবং প্রয়োজনীয় সম্পদ বরাদ্দ।
দেশের প্রতিটি উন্নয়ন সূচকের পেছনে মাঠ প্রশাসনের নিষ্ঠাবান এই সৈনিকদের অবদান অনস্বীকার্য। তাই আজকের ইউএনওরাই আগামী বাংলাদেশের উন্নয়ন ও কল্যাণের অন্যতম অগ্রদূত।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার, মাঠ প্রশাসনের অগ্রসেনানী – আর্টিকেল নিয়ে আপনাদের কোনো জিজ্ঞাস্য থাকলে কমেন্ট করুন আর ভালো লেগে থাকলে শেয়ার করুন।
নতুন কোনো আর্টিকেল নিয়ে আবার হাজির হবো, সকলের সুস্থতা কামনায়.. আজকের মতো বিদায়। আল্লাহ হাফেজ।
আমার অন্যান্য আর্টিকেল পড়ার নিবেদন রইলো, My Posts
চিঠিপত্র তৈরিতে আপনার প্রতি মুহুর্তে প্রয়োজনীয় এ্যাপস্ : Showkatbd.com