
নিভৃত এক কবির আলেখ্য : আলফাজ উদ্দিন ও তাঁর কাব্যভুবন
নিভৃত এক কবির আলেখ্য : আলফাজ উদ্দিন ও তাঁর কাব্যভুবন
— মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী

সাহিত্য কখনো কখনো জন্ম নেয় নিঃশব্দে, দূরে কোথাও, শহরের কোলাহল থেকে বহু দূরে, এক সরু গলির শেষে, খড়ের চালা ঘরের জানালায় বসে—যেখানে কেবল শুনতে পাওয়া যায় সুঁই ফোঁড়ার শব্দ, অথবা ধানক্ষেতে বাতাসের দীর্ঘশ্বাস। এমন এক নিভৃতপ্রাণ কবি ছিলেন আলফাজ উদ্দিন—যিনি বেঁচে ছিলেন শব্দে, হারিয়ে গেলেন নীরবতায়।
তিনি ছিলেন সময়ের অতল থেকে উঠে আসা এক নিরুত্তাপ সাক্ষী—যিনি কখনো মঞ্চে ছিলেন না, ক্যামেরার ফ্ল্যাশে ধরা পড়েননি, অথচ পত্রপাতায় রেখে গেছেন এক দীপ্ত কাব্যজীবন, যা আজও স্পর্শ করে আমাদের।
সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার টেংরাটিলা গ্রামের এই সন্তান জন্মেছিলেন ১৯৫৪ সালে, নরসিংদীর আজকিতলা গ্রামে তাঁর নানাবাড়িতে। শৈশবেই ফিরে আসেন টেংরাটিলায়—যেখানে খালের জল, কাশফুলের ছায়া, প্রান্তরের বাতাস ও গরুর গাড়ির চাকা মিলিয়ে গড়ে ওঠে তাঁর কবিতার প্রথম বর্ণমালা।
তিনি ছিলেন একাধারে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, মঞ্চকর্মী, সংস্কৃতিচার্য এবং নিভৃত কবি। তাঁর কলমে যেমন ছিল যুদ্ধের উদ্দীপনা, তেমনি ছিল এক প্রেমহীন গ্রামীণ বাস্তবতার ভেতরে প্রেমকে খুঁজে ফেরার এক প্রগাঢ় আকুতি।

তাঁর একমাত্র কাব্যগ্রন্থ ‘শিহরণ’, যা ২০১২ সালে হাতে লিখে সংকলন করেন, যেন এক আত্মজৈবনিক কাব্যালেখ্য। এই গ্রন্থে যেমন রয়েছে ষোলোই ডিসেম্বরের যুদ্ধোত্তর দৃশ্য, তেমনি রয়েছে আত্মদহন, পরাজয়ের কুয়াশা, নরম প্রেমের অনুরণন।
একটি কবিতায় লিখেছিলেন:
“অসুস্থ জননীকে শয্যায় রেখে,
সন্তান গিয়েছিল রণে /
ঘুরিয়াছে সে নয়টি মাস,
খালে বিলে আর বনে।”
এ পঙ্ক্তিগুলো আজ যেন তাঁর নিজের প্রতিচ্ছবি—এক যোদ্ধা, এক সন্তান, এক কবি—যিনি শেষ পর্যন্ত নিজেই হারিয়ে গেলেন এক ম্লান আলোর ভিতরে।
কবিতা ও জীবন : প্রতিরোধের নীরব কাব্য
আলফাজ উদ্দিন কোনোদিন সাহিত্য-সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন না, টিভির পর্দায়ও ছিলেন না। কিন্তু গ্রামীণ রাত্রির মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি যাত্রাপালা করেছেন, আবৃত্তি করেছেন নিজের লেখা কবিতা—নাট্যগৃহের মেঝেতে বসা শত শ্রোতা তাঁকে নিঃশব্দে শুনেছে।
১৯৭৫ সালে সেনানিবাসে কর্মরত অবস্থায় অভিনয় করেন ব্রজেন্দ্র কুমার দে-র নাটক “চাষার ছেলে”-তে। সে-অভিনয়ের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে রাজেন্দ্রপুর থেকে তারাপুর পর্যন্ত। তাঁর হাতে গড়ে ওঠে দোয়ারাবাজার অঞ্চলের প্রথম সাংস্কৃতিক দল, যেখানে কবিতা, নাটক, আবৃত্তি মিলিয়ে তৈরি হয় এক নীরব সাংস্কৃতিক বিপ্লব।
এক অপ্রকাশিত সাহিত্যভাণ্ডার
কবিতা ছাড়াও তিনি লিখেছিলেন উপন্যাস—‘কাঠের বাকসো’ (১৯৯৫) এবং ‘ব্যাংকের কেরানি’ (১৯৭৮)—যা আজও অপ্রকাশিত। কেবল লেখার খাতায় ছাপার কালির স্বপ্ন হয়ে রয়ে গেছে এই দুই সাহিত্যকীর্তি।
আমি তাঁর সান্নিধ্যে এসেছিলাম ২০১২ সালের দিকে, সাংবাদিকতা করতে গিয়ে। তখনই প্রথম শুনি তাঁর মুখে নিজের লেখা কবিতা। একদিন তিনি নিজেই আমাকে উৎসর্গ করে লেখেন ‘নবচন্দ্র’ নামে একটি কবিতা, যেখানে আমার নামের ‘হেলালী’ শব্দটি পায় চন্দ্রের প্রতীকায়িত রূপ:
“মরিচিকাময় জীবন আমার, ধূ ধূ ময় বালুচর /
ঘূর্ণি বাতাসে শূণ্যে উড়ায়, আসে যদি একটু ঝড়।”
এই পঙ্ক্তিগুলো এখন যেন শুধু আমার নয়, আমাদের সবার জন্য রেখে যাওয়া এক কাব্যিক বিদায়বাণী।
প্রস্থান : একটি অন্ধকার প্রহর ও একটি অম্লান আলো
২০২৩ সালের শেষভাগে তিনি চলে যান না-ফেরার দেশে। মৃত্যুর সংবাদ আসে নিঃশব্দে, কোনো খবরের শিরোনাম হয় না, কোনো ফেসবুক স্ট্যাটাস হয় না। শুধু তাঁর লেখা একটি ডায়েরি, কিছু পাণ্ডুলিপি, কয়েকজন শিষ্য এবং কিছু অস্ফুট উচ্চারণ রেখে যান পেছনে।
তাঁর মৃত্যু ছিল যেমন নিঃশব্দ, তাঁর জীবনও ছিল তেমনই—সাহিত্যের এক অপ্রকাশিত সন্ন্যাস। কিন্তু সেই নীরবতা ছিল না কোনো অনুপস্থিতি, বরং ছিল এক নিভৃত শঙ্খধ্বনি, যা কেবল মন দিয়ে শুনলেই শোনা যায়।
উপসংহার : কবিতা যাঁকে বেছে নেয়
আলফাজ উদ্দিন ছিলেন সেই কবি, যাঁকে কবিতা বেছে নিয়েছিল। যিনি আর্থিক কষ্টে থেকেও বেঁচেছিলেন শব্দে, যিনি প্রচারের বাইরে থেকেও হয়ে উঠেছিলেন প্রান্তিক মানুষের আত্মার অনুবাদ।
আজ আমাদের কর্তব্য এই কবিকে নতুন করে আবিষ্কার করা, তাঁর অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপিগুলো ছাপিয়ে আনা, তাঁর ‘শিহরণ’-কে পৌঁছে দেওয়া নতুন প্রজন্মের হাতে।
কারণ, আলফাজ উদ্দিন ছিলেন না শুধু একজন কবি—তিনি ছিলেন এক নিভৃত কণ্ঠস্বর, যে আজো বাতাসে ধ্বনিত হয় :
“আমি লিখে রাখি বালুচরে,
হয়তো একদিন কেউ পড়ে—
ঝরাপাতার নিচে খুঁজে পাবে কবিতা।”