
সোশ্যাল মিডিয়ায় অপব্যবহার অত:পর
সোশ্যাল মিডিয়ায় অপব্যবহার সম্ভাবনার মাঝেও সতর্কতার আহ্বান
বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও দ্রুতগতিতে ডিজিটালায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার এবং ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও মানুষ এখন বিশ্বকে জানতে পারছে, মতামত দিতে পারছে, এবং নিজেকে বিশ্বমানের প্ল্যাটফর্মে তুলে ধরতে পারছে। তবে এই প্রযুক্তির কল্যাণের পাশাপাশি আমাদের সমাজে ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহারও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে এসেছে।
ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রসার
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১৩ কোটিরও বেশি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। এর মধ্যে বিশাল একটি অংশ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম এবং এক্স (সাবেক টুইটার) – এসব প্ল্যাটফর্মে তরুণ-তরুণীদের সক্রিয়তা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি যেমন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতার একটি দরজা খুলে দিয়েছে, তেমনি অপব্যবহারের সুযোগও তৈরি করেছে।

অপব্যবহারের বহুমাত্রিক রূপ
বাংলাদেশে ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পাচ্ছে, যার মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য দিক হলো:
১. গুজব ও বিভ্রান্তিকর তথ্য
সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব ছড়ানোর প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। ধর্মীয় সংবেদনশীলতা, রাজনৈতিক ইস্যু, কিংবা সামাজিক ঘটনা – যেকোনো কিছুকে ভিত্তিহীনভাবে উপস্থাপন করে উস্কানি দেওয়া হচ্ছে। এসব গুজব সমাজে বিভ্রান্তি, হিংসা, এমনকি সহিংসতাও ডেকে আনছে।
২. সাইবার বুলিং ও হয়রানি
নারী ও কিশোরীরা ইন্টারনেটে সবচেয়ে বেশি সাইবার বুলিংয়ের শিকার হন। আপত্তিকর মন্তব্য, ফটোশপ করা ছবি, মিথ্যা অপবাদ দিয়ে মানসিকভাবে হয়রানি করার ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। এটি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত ক্ষতি করে না, বরং সমাজে একটি ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করে।
৩. ডিজিটাল প্রতারণা
ফেক অ্যাকাউন্ট, ভুয়া বিজ্ঞাপন, অনলাইন লোন বা পুরস্কারের ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। সাধারণ মানুষ এসব ফাঁদে পড়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
৪. গোপনীয়তার লঙ্ঘন
ব্যক্তিগত তথ্য ও ছবি চুরি করে ব্ল্যাকমেইল করা, হ্যাকারদের মাধ্যমে মোবাইল বা কম্পিউটার হ্যাক করে গোপন তথ্য চুরি করা – এসবও এখন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব কর্মকাণ্ডে ব্যক্তির সম্মানহানি ও নিরাপত্তা দুই-ই বিপন্ন হচ্ছে।
অপব্যবহার বৃদ্ধির কারণসমূহ
১. ডিজিটাল শিক্ষার অভাব: অধিকাংশ মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম, ইন্টারনেটের নিরাপদ ব্যবহার সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখে না।
২. আইনের প্রয়োগ দুর্বলতা: বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থাকলেও, অনেক সময় তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার হয়, আর সাধারণ মানুষের সমস্যা যথাযথভাবে সমাধান হয় না।
৩. সচেতনতার অভাব: সামাজিকভাবে অনলাইনে আচরণ, গোপনীয়তা রক্ষা বা ডিজিটাল শিষ্টাচার বিষয়ে সচেতনতা গড়ে ওঠেনি।
সোশ্যাল মিডিয়ায় অপব্যবহার রোধে করণীয় ও সম্ভাব্য সমাধান
বাংলাদেশে ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়াকে নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর ও গঠনমূলক করতে হলে নিম্নলিখিত উদ্যোগগুলো নেওয়া জরুরি:
✅ ১. ডিজিটাল শিক্ষার প্রসার
বিদ্যালয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে “ডিজিটাল লিটারেসি” পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। তরুণদের শেখাতে হবে কীভাবে নিরাপদে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হয় এবং কোন কোন বিষয় থেকে দূরে থাকতে হবে।
✅ ২. আইনের বাস্তব প্রয়োগ
সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার এবং কার্যকর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সাইবার ট্রাইব্যুনালের ক্ষমতা বাড়ানো ও দক্ষ জনবল নিয়োগের মাধ্যমে প্রযুক্তিগত সহায়তা জোরদার করতে হবে।
✅ ৩. গণসচেতনতা বৃদ্ধি
সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে গণমাধ্যম, ক্যাম্পেইন এবং ওয়ার্কশপের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে। শিশু-কিশোরদের অভিভাবকদেরও ভূমিকা নিতে হবে।
✅ ৪. সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের দায়িত্ব
ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকসহ আন্তর্জাতিক সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোকে স্থানীয়ভাবে কনটেন্ট মনিটরিং ও কমপ্লেইন ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে বাধ্য করতে হবে।
সম্ভাবনার দ্বার রুদ্ধ নয়
যদিও ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ায় অপব্যবহার বেড়েছে, তবু এর সম্ভাবনাও সীমাহীন। শিক্ষার প্রসার, উদ্যোক্তা তৈরিতে সহায়তা, গণতান্ত্রিক মতপ্রকাশের ক্ষেত্র তৈরি—এসব ক্ষেত্রে ইন্টারনেট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তাই এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করে বাংলাদেশকে একটি নিরাপদ ডিজিটাল সমাজে পরিণত করা সম্ভব।
উপসংহার
ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। এর অপব্যবহার যেমন আমাদের জন্য হুমকি, তেমনি সদ্ব্যবহার আমাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। প্রযুক্তিকে দোষারোপ না করে, প্রযুক্তি ব্যবহারে সচেতনতা ও শৃঙ্খলা গড়ে তুললেই আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশকে আরও নিরাপদ ও মানবিক করতে পারব।
আসুন প্রযুক্তিকে দোষারোপ না করে, এর মঙ্গলজনক দিকগুলো গ্রহন করে এগিয়ে যাই সম্মুখে