
স্মৃতির নদী, উত্তরাধিকার
আমরা যারা নদীর ধারে জন্মাই,
তাদের শরীরে স্রোতের স্বরলিপি,
জল ছিল না, ছিল এক ভাষার অবয়ব—
ঢেউ ছিল উচ্চারণ, কূল ছিল বিরামচিহ্ন।
প্রতিটি ঢেউ—
একটি অনুপুঙ্খ সময়,
প্রতিটি ভাঙন—
অদৃশ্য মানচিত্রের বিলুপ্ত প্রান্তর।
সুরমা,
তুমি কি কেবল জলছায়া?
নাকি এক নির্বাক প্রেরণার সংবেদ?
তোমার বুকে পার হয়েছে কেবল নয়—
আত্মবোধ, অঙ্গীকার, ভাঙা স্বপ্ন,
ফিরেও এসেছে—
জলধ্বনি কণ্ঠে বয়ে এনে
অচেনা প্রজন্মের মুখাবয়ব।
তোমার তীরে দাঁড়িয়েছিলেন
মজিদ মাস্টার—
যাঁর চোখে জ্বলে উঠত
শব্দের পাথরে ভবিষ্যতের ছায়া।
দেওয়ান আজরফ—
দর্শনের শুশ্রূষক,
চোখের ভাষায় যিনি চেনাতেন দিগন্ত।
আহবাব চৌধুরীর নীরবতা—
ছিল যেন একটি জাতিগত অনুচ্চার।
আরও দূরে—
রাধা কান্ত পাল পুঞ্জের প্রাচীন জমিদার,
যার নীরবতায় ইতিহাস গাঁথা ছিল রাজরেখার মতো।
এই নদীর জল ছুঁয়ে
উলুধ্বনিতে বেজে উঠেছিল গৃহস্থ ঈশ্বর।
শাঁখা, সিঁদুর, স্নর্ণলতা—
নারীর স্তব্ধ আহ্নিক চলনে
জেগে থেকেছে প্রজন্মের শপথ।
বলরাম ডাক্তার, গোপাল বাবু—
তাঁদের স্মৃতি আজও ধারে ধারে
ভেসে ওঠে, জলছায়ার অন্তর্লিখনে।
সুরমার স্রোতে সুর তোলে সাবিরুনের দামাইল গীত—
“লাল লীল মশারির তলে কিলা গো ভাবি ঘুমাইলা”,
ভাঙনের ভিতরেও গীতের গন্ধ রাখে গ্রামীণ ব্যাকরণ।
নদী স্রোতে বাজে আজানের সুমধুর ধ্বনি—
জল আর আকাশের মাঝখানে
ভেসে ওঠে আত্মার চিরন্তন আহ্বান।
“আমি চাইলাম যারে, ভবে পাইলাম না তারে”
—কফিল উদ্দিনের লিরিক বাজে সুরমার ঢেউয়ে,
বিচ্ছেদের বাউল, সুরের সাধক,
তাঁর সুরে মিশে আছে নদীর অন্তর্গত বেদনা।
একবার ভেবে দেখো,
নদী আর মানুষ কি আলাদা?
একজন প্রবাহিত, অন্যজন জটিল—
তবুও দুজনেই ইতিহাস ধারণ করে।
যে নদী ভাঙে, সে কেবল মাটি নয়—
চিহ্নও সরিয়ে নেয় নির্দ্বিধায়।
তবু ভাঙনের ভিতরই
একটি নতুন রেখা জেগে ওঠে—
নতুন পাড় নয়,
নতুন ধারণা, নতুন ভাষা,
এক নবজাত মুখ, যার চোখে
জল নয়—
প্রাচীন স্বপ্নের বর্ণালিপি…।
[…] স্মৃতির নদী, উত্তরাধিকার […]
[…] স্মৃতির নদী, উত্তরাধিকার […]