
অবাঙালি নাগরিক বিহারী ’দের ইতিহাস..
অবাঙালি নাগরিক বিহারী ’দের সম্পর্কে আজ কিছু তথ্য জানাবো। যা হয়ত এর আগে আপনি কখনো শুনেননি বা আগে কখনোই জানতেন না।
অবাঙালি নাগরিক বিহারী ’দের পরিচয় :
ভারতের পুর্বরাজ্য বিহার থেকে বাংলাদেশে আসা মুসলমানদের আমাদের দেশে ‘বিহারী’ নামে ডাকা হয় ৷ তারা মুলত অবাঙালি। বিহার রাজ্যের উত্তরে নেপাল, পশ্চিমে উত্তর প্রদেশ, দক্ষিণে ঝাড়খণ্ড আর পুবে পশ্চিমবঙ্গ। বিহার বৌদ্ব আর জৈন ধর্মের জন্মভুমি হলেও এতিহ্যগতভাবে হিন্দু-সংস্কৃতি প্রদান রাজ্য।
বাংলাদেশে বিহারীদের আগমন :
ভারত বিভক্তির আগে ও পরে ১৯৪৭ সালে বিহার রাজ্যে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মুখে সেখান থেকে বিপুল পরিমান মুসলিম তৎকালিন পাকিস্তানে চলে আসে। বহুজাতিক পাকিস্তানের তদানিন্তন সরকার এদের ‘মোহাজির’ হিসেবে পুর্ববাংলায় পুনর্বাসিত করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন এদের অধিকাংশই ‘অখণ্ড পাকিস্তানের’ পক্ষ অবলম্বন করে।
বিহারীদের প্রত্যাবর্তন:
স্বাধিনতার পর বিহারীদের কিছু অংশ পাকিস্তানে ফিরে গেলেও বেশির ভাগ বিহারী বাংলাদেশেই থেকে যায়। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট বিহারীদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভের উপযুক্ত বলে আদেশ দেয়। কিন্তু পাচ লাখ বিহারী পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন বেছে নিয়েছিল। কিছু প্রত্যাবর্তন রেডক্রসের মাধ্যমে কয়েক বছর ধরে বাস্তবায়িতও হয়েছিল । কিন্তু ১৯৭৮ সালে পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশে থাকা বাকি বিহারীদের নাগরিকত্ব দিতে অস্বিকার করায় থেমে যায় প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া। ফলে তখন থেকেই বিভিন্ন অঞ্চলে বিহারী ক্যাম্পে বসবাস করে আসছে এই বিহারীরা।
বিহারীদের ক্যাম্প :
বর্তমানে বাংলাদেশে ছড়িয়ে থাকা ১১৬টি ক্যাম্পে এই জনগোষ্ঠির কয়েক লক্ষ লোক বসবাস করে আসছে। অনেকে আবার বাংলাদেশের মুল সমাজের সাথে একিভুত হয়ে ব্যবসা-বানিজ্যে সম্পৃক্ত হয়েছেন এবং ২০০৮ এর ১৯ মে, ঢাকা হাইকোর্টের রায় অনুযায়ি দেড় লাখ বিহারী জনগোষ্ঠি বাংলাদেশের নাগরিক অধিকার ভোগ করে আসছেন। যারা যুদ্ধের পর জন্ম নিয়েছিল তারাও বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ও ভোটের অধিকার অর্জন করে।
পাসপোর্ট হয়না বিহারীদের :
সুপ্রিম কোর্টের ২০০৮ সালের একটি আদেশ অনুযায়ি, বিহারীদের জাতিয় ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার কথা থাকলেও তা হয়নি ৷ বেশিরভাগ বিহারী বাংলাদেশি পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য যোগ্য নন ৷ কারন তারা অস্থায়ি ক্যাম্পে বাস করেন ৷ বাংলাদেশের নিয়মানুযায়ি, পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য আবদেনকারিকে তার স্থায়ি ঠিকানা সরবরাহ করতে হয় ৷
বিহারীদের ভাষা :
নিজ জনগোষ্ঠির মানুষের সাথে তারা বিহারী ভাষায় কথা বলে। বিহারী ক্যাম্পগুলোর সাইনবোর্ডে ইংরেজি ও বাংলার পাশাপাশি উর্দুভাষা ব্যবহার করে ‘আটকেপড়া পাকিস্তানি’ কথাটি উল্লেখ থাকায় অনেকেই মনে করেন, তারা উর্দু ভাষাভাষি বা উর্দুই তাদের ভাষা । এমনকি উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমেও হরহামেশাই তাদের উর্দূভাষি হিসেবে তুলে ধরা হয়। কিন্তু আসলে বিহারীদের মাতৃভাষা উর্দু নয়। বিহারের ভাষাতেই তারা কথা বলে। যা মুলত হিন্দি ভাষার একটি আঞ্চলিক রূপ। তবে পাকিস্তান আমল থেকেই তারা দাপ্তরিক লেখালেখি উর্দু হরফেই করে আসছেন। যারা উর্দু ভাষা জানেন, তারা খুব সহজে পার্থক্যটা বুঝতে পারলেও সাধারণ বাঙালিরা এদের উর্দুভাষি মনে করে ভুল করে থাকে।
বিহারীদের ধর্মীয় বৈচিত্র আছে :
অনেকেই মনে করে বিহারীরা শিয়া মতাবলম্বি মুসলিম । বিষয়টি একেবারেই সঠিক নয়। তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠই সুন্নি মুসলিম। তবে শিয়া সম্প্রদায়ের মতো তাদেরও ইমামবারা রয়েছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পবিত্র আশুরার দিনে তারাও ‘তাজিয়া মিছিল’ বের করে থাকেন। সেখানে ইমাম হাসান-হোসাইনের প্রতিকি মাজার ও লাল-সবুজ ঝাণ্ডা ছাড়াও থাকে দুন্দাবি ঢাক বা ড্রামের তালে আগুন, তলোয়ার ও লাঠির খেলা করে থাকে ।
অন্যদিকে শিয়া মুসলিমরা এইদিনে বের করেন মাতমি জুলুস বা জুলুসে আযা (শোকের পদযাত্রা), যাকে বাঙালিরা ‘তাজিয়া মিছিল’ বলে ভুল করে।
হিন্দু সম্প্রদায়ের বিহারী :
বাংলাদেশে বসবাসকারি বিহারী জনগোষ্টি যে শুধু মুসলিম সংস্কৃতির ধারক বা বাহক, এমন ধারনটিও আবার সঠিক নয়। প্রকৃত সত্য হলো, তাদের মধ্যে হিন্দু জনগোষ্ঠিও রয়েছে যারা ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের সময় মুসলিম প্রতিবেশিদের সাথে বিহার থেকে এখানে পাড়ি জমিয়ে ছিলো। এদের বেশিরভাগই আমাদের দেশে মেথর বা সুইপার হিসেবে জিবিকা নির্বাহ করে থাকে। চট্টগ্রামের ঝাউতলায় হিন্দু বিহারীদের অনেকে বসবাস করে, যারা দুর্গাপুজায় চাদাও তুলে থাকে।

সুফিগান বা কাওয়ালি গানে বিহারীদের দুর্বলতা :
বিহারীদের মধ্যে বিশেষ ধারার সুফিগানের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে, যা ‘কাওয়ালি’ নামে পরিচিত। কেউ কেউ অনেক টাকা খরচ করে বাসায় কাওয়ালির জলসা আয়োজন করে। কাওয়ালদেরকে বকশিশ হিসেবে অনেকে টাকাও ছুড়ে দেয়।
বিহারীদের প্রিয় খাবার :
বিহারীদের প্রিয় খাবারগুলোর তালিকায় আছে বিরিয়ানি, টিক্কা, চাপ। এই খাবারগুলো তৈরিতেও তারা বেশ দক্ষ। বয়স্কদের বেশিরভাগই জর্দা দিয়ে পান খেতে পছন্দ করেন। বিশেষ করে ঢাকার মিরপুরে বেনারসি পল্লির তাতি ও কাপড় ব্যবসায়ি বিহারীদের বেশ পানের নেশা।
বিহারীদের সবাই মুক্তিযুদ্ধ বিরোধি ছিলেন না :
ষাটের দশকে আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের সময় এদের অধিকাংশই ‘অখণ্ড পাকিস্তানের’ কথা বলে বাঙালিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই অনেক বিহারী বাঙালিদের সাথে দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়েন। অনেকে একাত্তরে হানাদার ও রাজাকারদের সহযোগিতা করেন বলে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমনের শিকার হন বলে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন তথ্যে জানা যায়। তবে এর মানে এই নয় যে, বিহারীদের সবাই একাত্তরে স্বাধিনতা বিরোধি ছিলেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) একটি দলিল থেকে জানা যায়, ষাটের দশকে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে তৎকালিন ছাত্র ইউনিয়নের ব্যানারে কিছু বিহারী ছাত্রদেরও অংশগ্রহন ছিল।
অবাঙালি নাগরিক বিহারী মুক্তিযোদ্ধা :
মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে লড়াই করেছেন এমন এক বিহারী ছিলেন সৈয়দ খান। ১৯৭১ সালে চিলমারি বিওপির বাঙালি ইপিআর সদস্যদের সঙ্গে তিনিও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। পরে মুক্তিবাহিনির একজন যোদ্ধা হিসেবে ৬ নং সেক্টরে লড়াই করেন। দুটি যুদ্ধে বিরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য তাকে বির প্রতিক খেতাব দেওয়া হয়। (সূত্র : প্রথম আলো, তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না, ২৪ মে ২০১১)
বিহারী এক শহিদ মুক্তিযোদ্ধার নাম টিএম আলি। যিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। যুদ্ধে শত্রুর গোলার আঘাতে বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকায় প্রান হারান এই মুক্তিযোদ্ধা। বির প্রতিক উপাধি দেয়া হয় তাকে। (সূত্র : কালের কণ্ঠ, সুবেদার টি এম আলী লাল সালাম, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৫)
জীবন, জিবীকা ও শিক্ষা :
বিহারীদের ভাষ্য অনুযায়ি, ক্যাম্পগুলোর ছোট ছোট কক্ষে তাদের মানবেতর জিবনযাপন করতে হয় ৷ একটু বৃষ্টি হলেই সেখানে নানান ধরনের সমস্যা মোকাবেলা কবতে হয় তাদের ৷ শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায় তারা ভালো চাকরিও পান না ৷
বিহারীদের পাচ থেকে ১০ শতাংশ শিশু আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পায় । ফলে বিহারীরা নরসুন্দর, কসাই, রিকশা চালক, পরিবহন শ্রমিক, অটোমোবাইল মেকানিকের মত ছোট ছোট কাজ করে উপার্জন করতে বাধ্য হয় ৷ বিহারী পরিবারের শিশুদেরও তাড়াতাড়ি কাজ যোগ দিতে হয়, কারণ সন্তানদের শিক্ষিত করার মত আর্থিক সক্ষমতা তাদের নেই ৷
উন্মুক্ত মত প্রকাশের ব্লগ। লিখুন আপনার মতাদর্শ, জানুক সাড়া বিশ্ব।
মুক্তমত প্রচারে আপনার ব্লগ। একান্তই নিজস্ব এলোমেলো ভাবনা, দর্শন, মুক্তচিন্তার প্রচারই বলছি শুনোর উদ্দেশ্য। প্রতিদিন চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা, মাথায় কিলবিল করা এলোমেলো ভাবনা, আপনার অভিব্যক্তি, আপনার ভালো লাগা, ভালো না লাগা সকল বিষয়ের নিজস্ব অভিমত। লিখতে পারেন আপনার নিজস্ব উক্তি, কবিতা, ইসলামিক নিবন্ধ। মন্তব্য করতে পারেন সকল লেখকদের লিখা নিয়ে।