প্রায়শই আমরা একজন মানুষের তাৎক্ষনিক কর্মকান্ড দেখে বা লোকমুখে কিছু শূনে মন্তব্য জুড়ে ফেলি। একে অন্যের সাথে কানাঘুষা করি। ঐ লোকটির কর্মকান্ডের নেপথ্যে কি আছে বা কেনই বা লোকটি এই ধরনের কর্মকান্ডে লিপ্ত হলো তা কখনোই জানার বা বুঝার ইচ্ছা পোষন করিনা।
অথচ প্রতিনিয়ত আমরা তাই করে যাচ্ছি। কারো সম্পর্কে পুরোপুরি না জেনে, লোক মুখের কথা শূনে, বা নিজের চোখে বিস্তারিত না দেখে লোকটির উক্ত কর্মকান্ড ভালো বা মন্দ বিশেষন দিয়ে দিচ্ছি। অমুক খারাপ, অমুক ভালো, লোকটা ভালো না, তাকে দিয়ে সমাজের কোন উন্নয়ন হবেনা, সে ধর্ম কর্ম মানে না, নিজের স্বার্থে হারাম কাজকে হালাল করছে, লোকটি পশুর চেয়েও খারাপ – ইত্যাদি ইত্যাদি, কত্তো কত্তো বিশেষন। লোকটির ভালো মন্দ বিচারের দায়িত্ব যেন আমাদের উপরেই পড়েছে, বিচার করে ফেলছি, যেন আমরাই বিচারক।
অর্থাৎ আমরা চোখে যা দেখি আর লোকমুখে যা শুনি, তা দিয়েই মানুষকে বিচার করে ফেলছি। অথচ আমরা জানিও না তাদের অন্তরের অন্তস্থলে কী চলে বা কি আছে। যা কেবলমাত্র বান্দা আর তার মহান রবই (সৃষ্টিকর্তা) জানেন।
উসমানীয় সালতানাতের ঘটনা। সুলতান মুরাদ-৪ এর শাষনামল। সুলতান মুরাদ-৪, যিনি সেপ্টেম্বর 10, 1623 থেকে ফেব্রুয়ারী 8, 1640 পর্যন্ত সালতানাত পারিচালনা করেছিলেন।
সুলতান মুরাদ প্রায়ই ছদ্মবেশে তার সালতানাতের জনগনের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে বের হতেন। প্রায় সময়ের মতোই এক সন্ধ্যায় তিনি বের হলেন। ঘুরতে ঘুরতে এক জনবহুল স্থানে এসে দেখলেন, এক লোক রাস্তায় মরে পড়ে আছে। তার চারপাশে মানুষে গিজগিজ করলেও কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না মৃত লোকটিকে নিয়ে বা তার সৎকারের জন্য।
সুলতান আশেপাশের লোকজনদের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘লোকটা মরে পড়ে আছে, তবুও কেউ এগিয়ে আসছে না কেন? লোকটির পরিবারের কি কেউ নেই?’
‘আরে এ তো একজন ব্যাভিচারী, মদ্যপ কুলাঙ্গার!’ উপস্থিত লোকগুলো বলে উঠল।
‘যাই হোক, সে তো আমাদের নবি (সাঃ)-এর উম্মাতেরই একজন, নাকি? এখন আমাকে তার বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যেতে সাহায্য করুন’- সুলতান বললেন।
লোকদের সহায়তায় সুলতান মৃত লোকটিকে তার বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসলেন। এরপর সবাই চলে গেল। সুলতান থেকে গেলেন তার সহযোগী সমেত ।
লোকটির স্ত্রী মৃতদেহকে দেখা মাত্র কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তিনি বলতে লাগলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আপনার প্রতি সদয় থাকবেন! হে আল্লাহর বান্দা, ও আমার প্রিয়তম স্বামী, আমি তো দেখেছি আপনি সবসময় কতটা নিষ্ঠাবান ছিলেন!’
সুলতান স্ত্রী মহিলাটির কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘উপস্থিত জনতার কাছে যা কিছু শুনলাম, এরপরও সে নিষ্ঠাবান হয় কীভাবে ? যেখানে দুশ্চরিত্রের জন্য সে এতটাই ঘৃণিত যে ,তার মৃত্যু নিয়েও কারো মাথা ব্যথা ছিল না ?’
লোকটির স্ত্রী জবাব দিলেন, ‘আমি জানতাম এমনই হবে। তিনি প্রতি রাতে সরাইখানায় যেতেন ও তার সামর্থ অনুযায়ী পয়সায় যতটকু সম্ভব হতো, ততটুকু শরাব কিনে ঘরে নিয়ে আসতেন। এনেই সেগুলো নর্দমায় ফেলে দিতেন। বলতেন, ‘আমি আজ মুসলিমদের অল্পখানি বাঁচিয়ে দিলাম।’
তিনি কোনো পতিতাকে কিছু টাকা দিয়ে ঘরে নিয়ে আসতেন এবং ভোর পর্যন্ত তাকে কুরআন পাঠ করে শুনাতেন। তিনি বলতেন, ‘আজ আমি এক তরুণীকে এবং ঈমানদার কোনো যুবককে পাপ কাজে জড়িয়ে পড়া থেকে বাঁচালাম।’
লোকেরা তাকে শরাব কিনতে ও পতিতালয়ে যেতে দেখত এবং এই কারণেই তারা তাকে নিয়ে নানা ধরনের কথা বলতো এবং ঘৃনা করতো।
আমি একদিন তাকে বললাম, ‘আপনি মারা গেলে না কেউ গোসল করানোর থাকবে, না কেউ জানাজা পড়তে আসবে। কবর দেওয়ার জন্যও তো কেউ থাকবে না।’
তিনি হেসে বলেছিলেন, ‘ভয় পেয়ো না, ঈমানদারদের সুলতান আর সকল ধর্মনিষ্ঠ ব্যক্তিরাই আমার জানাজায় উপস্থিত থাকবেন।’
সুলতান এই কথা শুনে আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি বললেন, ‘আল্লাহর কসম! তিনি ঠিকই বলেছিলেন। কারণ আমিই সুলতান মুরাদ। আগামীকাল আমরা তাকে গোসল করিয়ে, জানাজা পড়ে সম্মানের সাথে কবর দিয়ে আসব।’
এমনই হলো। স্বয়ং সুলতান মুরাদ, রাজ্যের বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, সকল ধর্মপ্রাণ ও এলাকার জনসাধারণ সবাইই তার জানাজায় অংশগ্রহণ করল।
তাই আমাদের উচিত ভেবে চিন্তে, সত্য জেনে কারো সম্পর্কে কিছু বলা বা মন্তব্য করা। পাছে না আমরা গুনাহের ভাগিদার হয়ে যাই। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে :
‘হে মুমিনগণ, তোমরা অধিক অনুমান থেকে দূরে থাকো। নিশ্চয়ই কোনো কোনো অনুমান তো পাপ। আর তোমরা গোপন বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের গীবত করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তো তা অপছন্দই করে থাকো। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ অধিক তাওবা কবুলকারী, অসীম দয়ালু।’
পরিশেষে : আল্লাহ আমাদের অনুমান করে কথা বলা থেকে হেফাজত করুক। আমিন।
লিখতে ও পড়তে ভালোবাসি। আমার ছোটো জ্ঞানে যা ধরে তাই লিখার চেষ্টা করি।