
মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী এর সাম্প্রতিক সময়ের কবিতা
মানুষ, তারও ওপরে
এই মুহূর্তে সীমান্তের ওপারে গোলাবর্ষণ চলছে,
প্রতিদিনের মতোই—
স্বরবর্ণ ছিন্ন করে আকাশের বুক চিরে
ছুটে আসে যুদ্ধবিমানের গর্জন।
সংবাদপত্র লেখে: “Retaliation is necessary”,
একটি রাষ্ট্র বলছে—“সার্জিক্যাল”,
অন্যটি বলছে—“প্রতিরক্ষা”।
তবে হাশিমপুরের যে শিশুটি আজ তার বাবাকে খুঁজে ফিরছে,
তার কাছে কোনো রাষ্ট্রই উত্তর নয়।
পাকিস্তানের বালাকোটে আজ
একটি স্কুলঘরে কেবল শবদেহ,
আর ভারতের কুপওয়ারায়
একটি মা ঘুম পাড়ায় মৃত সন্তানের নাম জপে।
এই কি ধর্ম? এই কি কাঁটাতারের দর্প?
আমরা কি এখনো বুঝিনি—
ধর্ম নয়, জাতীয়তা নয়—
মানুষের রক্তের রং সর্বত্র লালই?
যেখানে মিনারে আজান থেমে যায় আতঙ্কে,
আর মন্দিরে ঘণ্টাধ্বনি ঢেকে যায় গোলার শব্দে—
সেখানে কেউ কি বলতে পারে—
সত্যের দখল কার?
পলিটিক্যাল টক শো-র অতিথিরা বলছেন,
“প্রয়োজনে আরও অভিযান চালাতে হবে।”
তারা বোঝেন না—
ড্রোনের ক্যামেরায় ধরা পড়া আগুন
একটি ছিন্ন হৃদয়ের ছবি বহন করে।
আমরা বলতে এসেছি—
এই কবিতা কোনো নিরপেক্ষতা নয়,
এ এক সক্রিয় পক্ষগ্রহণ—
মানবতার পক্ষে।
শান্তি এখন এক রাজনৈতিক লুজার শব্দ নয়—
এখন, এই সময়েই,
এই কবিতা চাই রেজিস্ট্যান্স হোক
পতাকার ওপরে মানুষের মুখ চেনার ডাক।
আমি বলি—
রাষ্ট্রেরা নিজেদের Update করুক,
কিন্তু মানুষ হোক Version-less—
একটি নামহীন মুখ,
যার চোখে কেবল ভালোবাসা,
স্মৃতি, প্রতিবাদ—
আর একটি জিজ্ঞাসা:
“এই শিশুটিকে কেন মারলে?”
আমরা চাই, কেউ আর না বলুক—
“পূর্বপুরুষেরা যুদ্ধ করেছিল”—
বরং বলুক—
“তারা ভালোবেসেছিল, প্রতিরোধ করেছিল
শুধু মানুষ হয়ে।”
হাওরভূমির জলে রবীন্দ্র খোঁজে মানুষ
(কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এঁর জন্মদিনে নিবেদিত)
নরম জলজ রোদে ঝুলে আছে এক ভাষাহীন মুখ,
যেখানে পদ্ম-সমস্যা নয়, জন্ম নিচ্ছে শোকের দ্রাঘিমা।
ছেঁড়া কাঁথার মতো কাঁপে দেশের মানচিত্র,
রবীন্দ্র, তুমিই শুধু পারো মলিন পঙ্ক্তিকে বাঁচাতে।
পিঁপড়া লাইন করে হাঁটে সীমান্তের দিকে,
প্রতিটি লাশ একেকটা অসমাপ্ত কাব্যের খসড়া।
হাওরের ঢেউয়ে আজ পাগল হাসানের দীর্ঘশ্বাস,
সে গায়— “জীবনের প্রেমটা ছিল ক্ষণিকের ভুল…”
নদী এখন আর প্রেমিকাকে ডাকে না,
তার জল কাঁদে, যেন বাউলের অবরুদ্ধ গলা।
পাখিরা উড়ে না আর, তারা শব্দহীন বর্ণমালায় বন্দী।
যুদ্ধবিমানের তাণ্ডবে ছিন্ন হয় গানের ডানা,
শান্তি ফিরে আসুক পাক-ভারত সীমান্তে— মানুষ হয়ে।
কাঁটাতারকে কবিতা বানাতে চায় এক শিশু,
তুমি আসো রবীন্দ্র, তাকে শেখাও মানুষের মানে।
এবং যুদ্ধবাজদের শোনাও— বুলেটে নয়, মানুষ জাগে কবিতায়।
তোমার জন্মদিনে, কবিগুরু— মানবতার নতুন ভোর চাই আজ এই পৃথিবীতে…।
মানুষ এখন এক লগ-ইন স্বরলিপি
ড্রোন না, যেন পাখিহীন উল্কা নামে—
শিশুর চক্ষু কাঁপে রক্তালো সন্ধ্যাতারে।
সংবাদ না, অদৃশ্য কায়ায় মৃতের সংখ্যা উড়ে আসে—
তারপরেই উনুন-ছবি, রসনার আস্বাদন দৃশ্য,
ততোধিক মানবতা! এক নিঃশব্দ চতুষ্পদ স্তুতি।
যুদ্ধ এখন এক অপূর্ণ নরম ঘোর,
মৃত্যু—কেবল একটি সময়চ্যুত শ্বাস,
ভালোবাসা?
সেই তো এখন বিলুপ্ত অভিধান-পৃষ্ঠা।
আমি যখন দেখি সীমান্ত রেখা,
হাসনের গানে আমার আঙুল ছুঁয়ে যায়—
নজরুলের পঙ্ক্তিতে বাজে বিদ্রোহের রাগ:
“গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই”।
মানুষ?
সে তখনই জন্মায়,
যখন ক্ষমা প্রস্ফুটিত হয় অস্ত্রের ফাটলে।
রক্তপাতের পরিমিতি
মৃতদেহ আর সংখ্যার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে এক গণিতে রক্তচাপ—
যার ক্যালকুলেটরে অশ্রুর ঘনত্ব, পেছনের বোতামে চাপা পড়ে শবযাত্রার ছায়াপথ।
তার ছায়া পড়ে মানচিত্রে, অথচ ছায়ার নাগরিকত্ব নেই—
পৃথিবীর সীমান্তরেখায় রোদ যেন বহিরাগত, হিমায়িত আলোয় ঠোঁট নড়ে না মানবতার।
পাক-ভারত সীমান্ত এক চলন্ত কাঁটাতার, যেটা কেবল মানুষ নয়—
ছিন্ন করে প্রেমের ফিতেয় বাঁধা স্মৃতি, শিশিরে লেগে থাকা গোপন গানও হয়ে যায় বুলেটধ্বনি।
মায়ের স্তনের দুধ, নাম না-জানা শৈশব, ওড়নার চিত্রলিপিও ছিঁড়ে ফেলে—
যেন এক ব্যালিস্টিক সূরা, মাতৃত্বের স্তব পড়তে পড়তে শব্দহীন হয়ে যায় আকাশ।
যুদ্ধ এখন এক ব্র্যান্ডেড গ্যালারী, ব্যালিস্টিক ম্যানেকুইনের মুখে রং মেখে হাসে—
তার ঠোঁটে বারুদের গ্লস, চোখে ডিজাইনার ধ্বংস, জ্বলন্ত শহর পরে যায় ‘সিজনস কালেকশন’ এ।
গণমাধ্যমে শান্তি কেবল মাইনাসের প্রচ্ছদ—শূন্যতা ছাপা হয় পরিসংখ্যানে—
পত্রিকার হরফে লুকিয়ে থাকে কফিনের ফাঁকফোকর, মৃত্যুর বিপণন হয় ছাপার জ্যামিতিতে।
প্রতিটি বিজয়ের ছায়া মাপে—কত পঙ্ক্তি অনাথ হলো, আর কত হৃদয় শব্দহীন লাশ বয়ে বেড়ায় চিরকাল।
কবিতা তখন ছিন্ন শির—অভিমানী ঈশ্বরের হাতে ধরা লাল রুমাল, যেখানে কেবল পাণ্ডুলিপি নয়, মনুষ্যত্বও রক্তাক্ত।
অন্তর্জাল জানালায় নিষিদ্ধ আকাঙ্ক্ষার অনুপ্রাস
জানালার ফ্রেমে এক নারীর মুখ—যেন বিকেলের চিন্তাশীলতা,
হাসিটা তার, অ্যাবসার্ড হাস্যরসের মতো—আত্মার আর্তি ঢেকে দেয়।
মাথায় ফুল, যেন সভ্যতার শেষ চেষ্টায় রঙিন একটি নিদর্শন,
দৃষ্টি তার, পুঁজিবাদের পাঁকে ডোবা স্বপ্নের শেষ দৃশ্যপট।
সে এক চলমান থিসিস—অপরাধ, প্রেম ও প্রতিবাদের মাঝামাঝি,
ইনবক্সের নীরবতাও যেখানে উত্তরাধুনিক প্রেমের ব্যাকরণে বাঁধা—
মজে যাই আমি পরকীয়া হাসিতে, নিষিদ্ধ আকাঙ্ক্ষার অনুপ্রাসে…।
কবিতা হয়ে ওঠে না
কবিতা হয়ে ওঠে না আমার
সন্ধ্যা পেরোলে শব্দেরা গলে পড়ে দৃষ্টিহীন গোধূলির পাঁজরে—
উত্তরাধুনিক উপমারা আঙুলের মতো কিলবিল করে মগজের গোপন উপত্যকায়,
তবুও তারা কবিতা হয়ে ওঠে না।
পঙ্ক্তিরা আসে রাতকানা জ্যোৎস্নার ডানায় ভেসে,
শব্দ হয়ে তারা নামে হাওরের মুখচ্ছবিতে—
যেখানে জলের দগ্ধ পিঠে ভাঙে বিষণ্ন চাঁদের প্রতিবিম্ব।
সমকালীন চিত্রকল্পেরা ফিরে আসে উন্মাদ এক হাস্যরোগীর ঠোঁটে—
বেদনাবিধুর, পাগল হাসানের মতো,
যার ঠোঁটে কাঁপে কুসুমভাঙা আর্তনাদ
আহা! কবিতা হয়ে ওঠে না আমার
তবুও আমি শব্দের গন্ধ টেনে নেই তালুতে,
তালুবন্দি করে নিই একটা অসমাপ্ত শোকগান,
আর হাওরের সন্ধ্যায় ফিরি একা,
যেখানে জলরেখা আমার চোখের ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে…
সাম্প্রতিক সময়ের কবিতা- আসলেই সাম্প্রতিক। ভালো লাগলো।
অসংখ্য ধন্যবাদ এবং ভালোবাসা জানাই