
জলালোকে মেঘমিথুন
জলালোকে মেঘমিথুন
একটি প্রেম ও প্রকৃতি দর্শনের গল্প, যেখানে হাওর কেবল জল নয়—জীবনের এক প্রতিচ্ছবি।
আষাঢ়ের অন্তিম সপ্তাহ।
দেখার হাওর এখন এক স্বপ্নময় জলপ্রাঙ্গণ। আকাশ প্রতিদিন ভেঙে পড়ে জলে, আর প্রতিটি ঢেউয়ে খেলে যায় হারিয়ে যাওয়া পূর্বজদের দীর্ঘশ্বাস। এই জলাভূমি কেবল প্রকৃতির দৃশ্য নয়—এ যেন এক জীবনের রহস্য-প্রহেলিকা।
রাইসা এসেছে বহু দূর থেকে – একজন গবেষক, তার বিষয়ের নাম “জীবনচক্রে প্রকৃতি ও মনুষ্য সম্পর্ক”। কিন্তু সে জানতো না, এই হাওরের বুকেই লেখা আছে এমন এক মিথ, যা কোনো গবেষণাপত্রে ধরা পড়ে না, কেবল হৃদয়ের গভীরে অনুরণিত হয়।
তার গাইড ইমরান – যাকে গ্রামবাসীরা বলে ‘ধারার ছেলে’ – জলে বেড়ে ওঠা এক প্রকৃতি-মানব, যার চোখে জল পড়ে না, জলই তার চোখ।
প্রথমদিনেই সে বলে—
এই হাওরে নামে বৃষ্টি, নামে জ্যোৎস্না—
কেউ বলে পূর্বপুরুষের কান্না,
কেউ বলে প্রেমের পুনরাগমন।
মাঝে মাঝে তারা একসঙ্গে নামে,
তখন হাওর কাঁপে… ঠিক যেমন কাঁপে মানুষের ভেতরের প্রেমচক্র।
রাইসা হেসে ফেলে—
“তুমি তো কবির মতো ভাবো, বাস্তবকে ছুঁয়ে থাকতে পারো তো?”
ইমরান চোখ মেলে আকাশের দিকে তাকায়—
“বাস্তব বলে কিছু নেই, যদি না তাকে অনুভব করা যায় গভীরভাবে।”
দিন কেটে যায়, হাওরের আলো-ছায়া বদলায়।
রাইসা দেখে, প্রতিটি বৃষ্টি যেন কোনো প্রাচীন স্মৃতির পুনরাবৃত্তি,
প্রতিটি সূর্যাস্ত যেন অমীমাংসিত প্রার্থনার সমাপ্তি।
চতুর্থ রাতে, হাওরের ওপর নামে এক গভীর বৃষ্টি।
তারই মাঝখানে ঝরে পড়ে অদ্ভুত এক রূপালি জ্যোৎস্না।
কুয়াশা ঢাকা কাদায় দাঁড়িয়ে রাইসা দেখে জলের বুকে জেগে উঠেছে এক অলৌকিক প্রতিফলন—
জলের ভিতরে আকাশ, আকাশের ভিতরে বৃষ্টি, আর সেই বৃষ্টিতে মিশে আছে এক নিঃশব্দ অভিসার।
সেই রাতে ইমরান বলে—
তুমি জীবনচক্র খুঁজতে এসেছো,
অথচ এই হাওর তোমাকে শেখাবে প্রেমচক্র।
তুমি আর আগের রাইসা থাকবে না।
রাইসার মনে হয়, এই আলো, এই জলের স্বপ্নে সে বহুকাল আগে হেঁটেছিল।
তার গবেষণাপত্রের পৃষ্ঠাগুলো যেন হাওরের বাতাসে উড়ছে—প্রতিটি শব্দ নতুন অর্থ নিচ্ছে।
প্রেম হয়ে ওঠে দর্শন,
বৃষ্টি হয়ে ওঠে প্রিয়জনের অশ্রু,
আর জ্যোৎস্না—প্রেমের গোপন চিঠি, যা কেবল প্রকৃতি পাঠ করে।
বিদায়ের দিন।
রাইসা হাওরের বাঁকে দাঁড়িয়ে বলে—
আমি খুঁজতে এসেছিলাম সূত্র আর উপপাদ্য,
ফিরে যাচ্ছি এক দিগন্তস্পর্শী অনুভবে।
এই হাওর কেবল জল নয়—
যেখানে দেখা যায় প্রেমের অবিকল প্রতিবিম্ব।
পেছনে ধীরে নামে বৃষ্টি,
আর হাওরের বুকজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে নরম জ্যোৎস্না।
এই মিলন—জলালোকে মেঘমিথুন—
আরো একটি হৃদয়কে ছুঁয়ে দিয়ে হারিয়ে যায় প্রকৃতির অন্তহীন চক্রপথে…।
[পাদটীকা / লেখকের নোট (ঐচ্ছিক)]:
এই গল্পে ‘দেখার হাওর’ প্রকৃতির বাস্তবতা ও মানুষের হৃদয়দর্শনের মধ্যে এক সেতুবন্ধন। এখানে জল, আলো, মেঘ ও মানবচরিত্র—সবকিছু মিলেমিশে তৈরি করে প্রেমচক্রের এক কাব্যিক বিন্যাস।
উন্মুক্ত মত প্রকাশের ব্লগ। লিখুন আপনার মতাদর্শ, জানুক সাড়া বিশ্ব।