জলঘুমে জমে থাকে চন্দনের গন্ধ
জলঘুমে জমে থাকে চন্দনের গন্ধ
চন্দনকুঞ্জ—বাঁশ ও আমগাছ ঘেরা এক পুরনো বনবিলাস, নদীর ধারে নিঃসঙ্গ একটি প্রাসাদ। বাড়ির চাল ধূসর, কাঠের জানালা সবুজ শেওলায় ঢাকা। বিকেল হলেই বাতাসে ভেসে আসে এক অদ্ভুত গন্ধ—জলের মতো শীতল, চন্দনের মতো কোমল।
ইরাবতী প্রথম আসে বসন্তের শেষ সপ্তাহে। কলকাতার কোলাহল ছেড়ে সে এসেছে এই পুরনো বাড়িতে কিছুটা একাকীত্ব, কিছুটা শান্তি খুঁজতে। কিন্তু চন্দনকুঞ্জ যেন শুধুই বাড়ি নয়—এক বন্ধ দরজা, যার ওপারে ঘুমিয়ে আছে এক অলিখিত গল্প।
প্রথম সন্ধ্যায় জানালার পাশে বসে সে দেখে বাড়ির পুরনো কুয়োতলা, যার জলে প্রতিফলিত হয় এক মুখ—তার নিজের নয়, অথচ যেন অনেক চেনা। সেই রাতেই আসে প্রথম স্বপ্ন।
স্বপ্নে এক শিল্পী ক্যানভাসে আঁকছে ইরাবতীর প্রতিচ্ছবি। কিন্তু দেয়ালের ফ্রেমে সেই একই ছবি বহু আগে আঁকা। শিল্পী বলে,
“তোমার প্রতিচ্ছবি আমি অনেক বছর আগে এঁকেছিলাম,
তখন তুমি ছিলে জলরেখার ওপারে—
আমার গন্ধে বাসা বাঁধা এক সন্ধ্যা।”
ইরাবতী ফিসফিস করে, “তুমি কি আদিত্য?”
উত্তরে কেবল ভেসে আসে এক বাঁশির সুর—জলের মত, স্মৃতির মত।
পরদিন সকালে সে খুঁজে পায় একটি পুরনো ডায়েরি।
পাতায় লেখা:
“গোপন প্রেমের পসরা আমি সাজিয়ে রাখি মনের গহীনে।
কেউ জানে না, আমি জলঘুমে জেগে থাকি তার প্রতীক্ষায়।
প্রতিটি বৃষ্টির রাতে স্বপ্ন আঁকি তার মুখ,
যার ছায়া শুধু জলের নিচে ভেসে বেড়ায়।”
বাড়ির প্রতিটি ঘরে ছড়িয়ে থাকে এক অলৌকিক আবেশ—
দেয়ালে ঝুলে থাকা ছবিতে তারই মতো মুখ,
প্রতিদিন জানালায় রেখে যাওয়া এক অপরিচিত ফুল,
রাতের গভীরে বাঁশবনে বাজে সেই বাঁশির সুর।
এক সন্ধ্যায়, সরোবরপাড়ে বসে ইরাবতী বলে ফেলে—
“তুমি যদি থাকো, আমি ফিরে আসব বসন্তে… প্রতিবার।”
হঠাৎ জলে ওঠে এক মৃদু ঢেউ। কোথাও বাজে বাঁশি।
কেউ যেন বলে ওঠে—“আমি আছি… অভিসারে।”
সেই রাতে জানালার পাশে বসে ইরাবতী দেখে—ছবির শিল্পী হঠাৎ চোখের পাতা নামায়।
পরদিন সকালে, তার পাশে রাখা একটি নতুন খাতা।
প্রথম পাতায় লেখা:
“এই গল্প শেষ নয়।
ভালোবাসা থেকে যায় গন্ধ হয়ে—
জলের নিচে, ঘুমের তলায়,
প্রতিটি ফেরা বসন্তে।”


